কর্পোরেট সিন্ডিকেটঃ পরিবর্তনের উপায়
ইচ্ছাশক্তি ও দক্ষতার ভিত্তিতে প্রতিষ্টানে চার ধরনের লোক কাজ করে। এরা প্রতিষ্টানকে ধীঘর্স্থায়ী উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে পারে আবার প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেও দিতে পারে।
1. Parasite Employee: এই ধরনের এমপ্লয়ীদের কাজ করার ইচ্ছা ও দক্ষতা কোনটাই থাকে না। এরা অলস প্রকৃতির হয়, প্রতিষ্ঠানে চড়ে বেড়িয়ে খেতে পছন্দ করে। এরা যখন প্রতিষ্ঠানে জয়েন করে তখন তাদের কি কাজ করতে হবে তা না খুজে প্রতিষ্ঠান কাদের ক্ষমতায় বেশী চলে সেই সব লোকদেরকে খুজে বের করার চেষ্ঠা করে এবং সেইসব লোকের সাথে লিয়াজু বজায় রেখে চলে।
2. Monkey Employee: এই ধরনের এমপ্লয়ীদের প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকে কিন্তু দক্ষতা কম থাকে। এরা নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে সচেতন এবং নিজেদেরকে উচ্চ অবস্থায় নিয়ে যাবার জন্য সচেষ্ট থাকে। এদেরকে Monkey Employee বলার কারন হল এরা বানরের মত এর্নাজেটিক হয় এবং অল্প সময়ে অনেককিছু করে ফেলার চেষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠানে অনেক কিছু পরিবর্তন আনার আশা পোষন করে, নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করতে চায়, প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করতে চায়। সাধারনত এরা কোম্পানীতে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মী যেমন ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনী, এক্সিকিউটিভ, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ, অফিসার, সিনিয়র অফিসার এই লেভেলের হয়ে থাকে। এদের নতুন কিছু করার প্রবল ইচ্ছা থাকে কিন্তু এদের কাজের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা কম থাকে।
3. Visionary: এই ধরনের এমপ্লয়ীরা খুব অভিজ্ঞ ও দক্ষ এবং প্রবল ইচ্ছাশক্তি সম্পন হয়। এরা প্রতিষ্ঠানের ও ব্যবসার সব কিছু তাদের নিয়ন্ত্রনে রাখে। এরা প্রতিষ্ঠানকে কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে, প্রতিষ্ঠানে কীভাবে কর্পোরেট কার্লচার আনবে, প্রতিষ্ঠানকে আরও গতিশীল করবে, ব্যবসাকে কিভাবে টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী করবে তা নিয়ে কাজ করে। এরা মূলত টপ ম্যানেজমেন্ট যেমন CFO, COO, GM লেভেলের হয়ে থাকে।
4. Star Performer: এই ধরনের এমপ্লয়ীরা খুব অভিজ্ঞ ও দক্ষতা সম্পূর্ণ হয়ে থাকে। এরা দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানে কাজ করে এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় যথেষ্ট ভুমিকা রাখে কিন্তু এদের নতুন কোন কিছু করার ইচ্ছাশক্তি কম থাকে। মূলত এরা বিভাগীয় প্রধান, ম্যানেজার ইত্যাদি সিনিয়র লেভেলের লোক হয়ে থাকে। প্রতিষ্টান পরিচালনায় ৮০% ভুমিকাই এরা পালন করে।
এখন প্রশ্ন হল এই চার ধরনের এমপ্লয়ীদের মধ্যে কারা সবচেয়ে বেশী বিপদজনক?
কেউ কেউ মনে করে মান্কি এমপ্লয়ীরা বিপদজনক কারন তারা কি করতে হবে তা না জেনে শুধু পরিবর্তন জন্য আশা করে থাকে। আবার কেউ বলে অলস লোকরা বিপদজনক কারন তারা কোন কাজতো করেই না বরং অন্যরা কাজ করতে গেলে তাদেরকে কাজ করতে বাধা প্রদান করে। তারা সবসময় নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে থাকে এবং সবসময় নেতিবাচক কর্পোরেট পলিটিক্স নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
খুবই আশ্চার্য্য হলেও সত্য যে প্রতিষ্ঠানে এর চার ধরনে এমপ্লয়ীদের মধ্যে সবচেয়ে বিপদজনক হল স্টার পারফরমাররা। কারন প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আগামীতে কি করতে হবে, কেন করতে হবে, কখন করতে হবে, কোথায় করতে হবে এবং কিভাবে করতে হবে সব কিছু তাদের নখে দর্পনে জানা থাকা সত্ত্বেও তারা পরিবর্তনের জন্য কোন পদক্ষেপ নিতে চায় না। তাদের ইচ্ছাশক্তিকে দমিয়ে রাখে। তারা মনে করে প্রতিষ্ঠানের জন্য অনেক করেছি, প্রতিষ্ঠানের জন্য আরও কিছু করলেও বা না করলেও, যা মাইনে পাচ্ছি তাই পাব। তো আর বেশী কিছু করার কি দরকার। পাশাপাশি স্টার পারফরমারদের আরেকটি বড় সমস্যা হল প্যারাসাইট এমপ্লয়ীরা। স্টার পারফরমাররা অন্য থেকে সম্মান পাওয়ার আশায় থাকে। আর এই সুযোগে প্যারাসাইট এমপ্লয়ীরা তাদেরকে সব সময় জি হুজুর জি হুজুর করে ও চাটুকারিতায় লিপ্ত থাকে। বিভাগের প্রধানরা এতে সম্মানবোধ করে ফলে প্যারাসাইট এমপ্লয়ীদেরকে শেলটার দেয়া শুরু করে, তাদেরকে অনৈতিক সুযোগ সুবিধা প্রদান করে এবং উভয়ে মিলে প্রতিষ্ঠানে Negative Political Nexus (কর্পোরেট সিন্ডিকেট) তৈরী করে বসে।
অলস ও অসাধু এমপ্লয়ীরা প্রতিষ্ঠানে কোথায় কি হচ্ছে, না হচ্ছে, কে কি করছে বা না করছে তা যোগ বিয়োগ করে বিভাগীয় প্রধানদেরকে বোঝায় এবং কি করলে প্রতিষ্ঠানে তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে তা নেতিবাচকভাবে তাদের কাছে উপস্থাপন করে। স্টার পারফরমাররা নিজেদের অবস্থান আরও জোড়ালো করার জন্য অন্যদের কথায় মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয় এবং তাদের সাথে নেগেটিভ কর্পোরেট পলিটিক্স নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার গতি নষ্ঠ হয় এবং প্রতিষ্ঠানে একধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়।
অপরদিকে, এনারজেটিক এমপ্লয়ীরা যখন প্রবল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন উদ্দ্যোগ ও আইডিয়া বিভাগের প্রধানদেরকে জানায় তখন বিভাগের প্রধানরা তাদের কথাকে গুরুত্ব দিতে চায় না বা তাদের কথা শুনতে রাজী হয় না অথবা বেশী পন্ডিত হয়ে গেছে বলে তাদেরকে তিরষ্কার করা হয়। এতে তারা অনুৎসাহিত হয়, তাদের ইচ্ছাশক্তিতে মরিচিকা ধরে, ইনেশিয়েটিভ নেয়ার ইচ্ছা নষ্ঠ হয়ে যায়, তাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায়, প্রতিষ্ঠানকে নিজের করে নেয়ার (Ownership Development) ইচ্ছা চলে যায় এবং তাদের পারফরমেন্স কমে যায়। তারা শুধু ততটুকু কাজ করে যতটুকু করলে দায় এড়ানো যায়। পাশাপাশি নিজেদের ক্যারিয়ার গঠনের জন্য অন্য প্রতিষ্টানে চাকুরী খুজতে শুরু করে এবং প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে যায়।
এখন প্রশ্ন হল প্রতিষ্ঠানে এমন পরিস্থিতি হলে পরিবর্তনের ভার কে নিবে?
রিচার্জসন নামক একজন গবেষক বলেন, পরিবর্তনের ভার নিতে হবে ভিশনারী এমপ্লয়ীদেরকে । কারন তারা যদি পরিবর্তনের হাল না ধরে তাহলে প্রতিষ্ঠান কিছু দিনের মধ্যে গতিহীন হয়ে যাবে, অস্থিতিশীল ও খারাপ কর্ম পরিবেশ তৈরী হবে, কর্মীদের মধ্যে অসন্তুষ্টী কাজ করবে, সংগঠনের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। ফলে ভাল ও দক্ষ এমপ্লয়ীরা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে চলে যাবে, প্রতিষ্ঠানে হিউম্যান ক্যাপিটেল (Human Capital) কমে যাবে। উৎপাদন ব্যহত হবে, প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা কমে যাবে এবং একসময় প্রতিষ্ঠান ক্ষতির সম্মুক্ষীন হবে ও প্রতিষ্ঠান বিলীন হয়ে যাবে।
করণীয়:
ভিশনারীরা খুব দক্ষতা ও সর্তকতার সাথে স্টার পারফরমারকে নিয়ে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে দুটি কাজ করতে হবে পরিশোধন করা (Purify) অথবা বিলুপ্ত করা (Evaporate)
প্রথমতঃ স্টার পারফরমারদেরকে বিভিন্ন ট্রেনিং, কাউনসিলিং, বিভিন্ন কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত (Employee engagement) করে এবং কাজের স্বীকৃতির মাধ্যমে অনুপ্রেরণা প্রদান করে প্রতিষ্ঠানের প্রতি আরও বেশী দায়িত্বশীল করে গড়ে তোলা যায়। পাশাপাশি স্টার পারফরমারদের থেকে কিছু দুষ্ট এমপ্লয়ীকে প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দিতে হবে যাতে করে তাদের যে Negative Political Nexus (কর্পোরেট সিন্ডিকেট) ছিল তা ভেঙ্গে যায়। এর ফলশ্রুতিতে প্যারাসাইট এমপ্লয়ীরা ভীত সন্তুষ্ঠ হবে ও বিছিন্ন হয়ে যাবে এবং তাদের নেতিবাচক প্রভাব থেকে স্টার পারফরমাররা মুক্ত হবে।
দ্বিতীয়তঃ নতুন ও উদ্দ্যোমী এমপ্লয়ীদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ট্রেনিং প্রদানের ব্যবস্থা করা। তাদের ইচ্ছা ও উদ্দ্যোগের সাথে সাথে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করলে তারা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য নতুন সূচক তৈরী করতে সাহায্য করবে। বলা হয় “when will is recognized, skill will developed” নতুনরা যখন ভিশনারীদের সহচার্যে আসবে, সঠিক ট্রেনিং ও মেনটরিং পাবে তাদের মধ্যে লিডারশীপ ক্ষমতা জাগ্রত হবে, তারা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য সবোর্চ্চ প্রচেষ্টা করবে। এতে প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তনের সূচনা হবে এবং প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের গতিশীলতা আসবে।
প্রতিষ্ঠানে যখন পরিবর্তন আসা শুরু হবে তখন প্যারাসাইট এমপ্লয়ীরা বাধ্য হয়ে নিজে নিজে প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে যাবে অথবা নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখার জন্য ট্রেনিং গ্রহন করে পরিবর্তনের সাথে নিজেকে খাপখায়িয়ে নিয়ে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য কাজ শুরু করবে। অন্যদিকে বিভাগীয় প্রধানরা তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার পাশিপাশি নতুন নতুন উদ্দ্যোগ গ্রহন করে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উর্দ্দেশ্যকে বাস্তবায়ান করার জন্য অগ্রণী ভুমিকা পালন করবে।
সর্বোপরি দেখা যাবে প্রতিষ্ঠানে প্যারাসাইট এমপ্লয়ীদের হার কমে যাবে। মান্কি এমপ্লয়ী, স্টার পারফরমার ও ভিশনারীরা একসাথে কাজ করে টীম বিল্ডিয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানে উন্নত কর্পোরেট কালর্চার তৈরী হবে, এমপ্লয়ীরা প্রতিষ্ঠানকে নিজের করে নিতে শিখবে যার ফলশ্রুতিতে গতিশীল, টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের দিকে প্রতিষ্ঠান এগিয়ে যাবে।
যে কোন ভাল উদ্দ্যোগকে উড়িয়ে দেয়া উচিত নয় । প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ইনিশিয়েটিভকে স্বীকৃতি দেয়া উচিত। বলা হয় ”Your determination determines your destination”। যখন কারো ভাল উদ্দ্যোগকে স্বীকৃতি দেয়া হয় তখন সে মুটিভেটেট হয়, কাজের প্রতি সম্পৃত্ততা ও প্রচেষ্টা বেড়ে যায়। এই কথা সত্য যে, টাকা কখনো মানুষকে মুটিভেটেট করে না, করলেও তা সাময়িক। টাকা যদি মানুষকে মুটিভেটেট করতো তাহলে এমপ্লয়ীরা সর্বোচ্চ বেতন পাওয়ার পরও প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করে অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যেত না। এমপ্লয়ীদেরকে সঠিক স্বীকৃতি দেয়াই সবচেয়ে বড় মোটিভেশনাল ফেক্টর হিসেবে কাজ করে।
প্রতিষ্ঠানে যে কোন ধরনের পরিবর্তন সহজে কেউ তা মেনে নিতে চায় না। পরিবর্তনের জন্য বাধা সৃষ্টি করে। কারন আমাদের ”Believe System” এর মধ্যে ”পরিবর্তনকে” ভয় ও হুমকী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছি। তাই যে কোন পরিবর্তন আনা জন্য প্রথমে আমাদের ”Believe System” এর পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। আর তার জন্য আমাদেরকে পড়ার অভ্যাস ও ট্রেনিং গ্রহন করার সংস্কৃতি তৈরী করতে হবে। প্রতিষ্ঠানে ট্রেনিং এর সংস্কৃতি তৈরী হলে এমপ্লয়ীদের জ্ঞান, দক্ষতা ও সামর্থ্য বৃদ্ধি পাবে। এতে করে ”Believe System” এর পরিবর্তন আসবে এবং পরিবর্তনকে খুব সহজে মানিয়ে নিয়ে তারা প্রতিষ্ঠানের টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের জন্য কাজ করবে।
No comments